রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস

রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস
রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস

দুই চাকার মোটরযানের প্রতি আমাদের সবারই দুর্বলতা কাজ করে। এসব যানের দ্রুতগতি, নজরকাড়া ডিজাইন, যেকোনো রাস্তায় চালানোর সুবিধা এবং চার চাকার গাড়ির থেকে কম দামের করণে গরিব-ধনী সবার কাছে চলাচলের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আমরা সাধারণত যেসব ডিজাইনের মোটরসাইকেল দেখি তার থেকে ভিন্ন কোনো জিজাইনের মোটরসাইকেল সামনে আসলে সহজেই আমাদের নজর কাড়ে।

বিখ্যাত মোটরসাইকেল রয়েল এনফিল্ডকে অনেকেই মনে করে যে এটি ভরতের ব্র্যান্ড। এমনকি তারা নিজেরাও মনে করে যে এটি তাদের নিজস্ব পন্য। ভরতের সংস্কৃতির সঙ্গে এটি এমনভাবে জড়িয়ে গেছে, এই কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের মালিকানা যে ভরতের নয় তা অনেকেই জানে না। যারা এরকম কিছু মনে করে থাকেন, তাদের জন্য আজকের এই পোস্টি।

মূলত রয়েল এনফিল্ড এর জন্ম ব্রিটেনে। রয়েল এনফিল্ড প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমন কিছু মোটরসাইকেল তৈরি করে থাকে যা সব বয়সের মানুষের কাছেই আকর্ষণের বস্তু।

১৮৯৮ প্রথম মোটরচালিত যান তৈরি করলেও রয়েল এনফিল্ড এর মোটরসাইকেলের যাত্রা শুরু হয় ১৯০১ সালে। নতুন শতাব্দীতে এক নতুন চমক নিয়ে আসে রয়েল এনফিল্ড।

রয়েল এনফিল্ড এর যাত্রা শুরুর ইতিহাস

রয়েল এনফিল্ড এর রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র ইংল্যান্ডে জন্ম হলেও এই কোম্পানি শীর্ষে উঠে ইংল্যান্ডের অন্যতম শোষণেল কেন্দ্র ভারতে।

রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস
সূত্র: www.royalenfield.com

১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডের রেড্ডিচ শহরে জর্জ টাউনসেন্ট নামের একজন ব্যবসায়ী সেলাই মেশিনের সূচ তৈরির কারখানা স্থাপন করেন এবং ধাতুর কাজের জন্য বেশ কয়েকটি মেশিন স্থাপন করেন। ১৮৮২ সালে টাউনসেন্ডের ছেলে এই কারখানার যন্ত্রপাতির সাহায্যে স্যাডেল এবং ফর্ক তৈরি শুরু করেন। এই ব্যবসায় তিনি প্রথমে লাভের মুখ দেখতে পান। যেহেতু তার কাছে বাইসাইকেল তৈরি করার মতো যন্ত্রপাতি ছিল, তাই ১৮৮৬ সালে তিনি ‘টাউনসেন্ড এন্ড একোসাইস’ নামে বাইসাইকেল তৈরি করে বিক্রি শুরু করেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই সময় বাইসাইকেরের বাজারে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। ফলে বাজারজাতকরন পরিকল্পনা ভাল না থাকায় ১৮৯১ সালে কোম্পানিটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

টাউনসেন্ডের পরামর্শদাতার পরামর্শ অনুযায়ী অ্যালবার্ট এডি নামে বারমিংহামের একজন সেলস ম্যানেজার এবং রবার্ট ওয়াকার স্মিথ নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের হাতে কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

অ্যালবার্ট এডি ছিলেন একজন উচ্চভিলাষী মানুষ। ১৮৯২ সালে তিনি এর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন এডি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এই কারখানায় অনেক সূক্ষ যন্ত্রপাতি তৈরির মেশিন স্থাপন করা হয়। ১৮৯৬ সালে মিডলসেক্সের এনফিল্ড শহরে অবস্থিত রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরির জন্য যন্ত্রপাতি তৈরির কন্ট্রাক্ট পান। আর এখান থেকেই রয়েল এনফিল্ড নামের শুরু হয়। সেই বছরই তারা নিউ এনফিল্ড সাইকেল কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি ক্রয় করেন এবং এখান থেকেই ১৮৯৭ সালে সাইকেলের সব ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি শুরু করে।

রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস
সূত্র: www.royalenfield.com

পরবর্তীতে যখন মোটর চালিত সাইকেল ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল তখন রয়েল এনফিল্ড কোম্পানিও মোটরসাইকেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দুই বছর চেষ্টার পর এনফিল্ড ১৯০১ সালে তাদের প্রথম ২৩৯ সিসি মোটর বাইক বাজারে আনে।

১৯০২ সালে তারা একটি মোটরগাড়ি বানায় এবং ১৯০৬ সারে অটোকার কোম্পানি স্থাপন করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল চার চাকার যানবাহনের বাজার দখল করা। কিন্তু ১৯ মাস পরেই লোকসানের করণে বন্ধ হয়ে যায় তাদের মোটর গাড়ির কারখানা।

এরপর তারা তাদের সমস্ত সম্পদ লাগিয়ে দেয় মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন এবং ডিজাইন উন্নয়নে। ১৯০৯ সালে তারা প্রথম ২৯৭ সিসি V-Twin ইঞ্জিন তৈরি করে যা ১৯১১ সালে ৩৪৪ সিসি করা হয়। ১৯১২ সারে ৭৭০ সিসি V-Twin JAP Model 180 বের হয় যার সাথে একটি সাইডকারও ছিল। ১৯১৩ সালে তারা ৪২৫ সিসির মডেল ১৪০ বের করে। এগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে মানুষের কাছে।

রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের যাত্রা ও ইতিহাস
সূত্র: www.royalenfield.com

১৯১৪ সালে রয়েল এনফিল্ড এর প্রথম ২-স্ট্রোক মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ উৎপাদনে আসে। যেহেতু ব্রিটেন সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পরে, সেই সুবাদে কোম্পানির সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল 770 CC 6 hp V-twin এর উৎপাদন অগ্রাধিকার পায়।

এই যুদ্ধের সময় কোম্পানিটি ব্রিটিশ, বেলজিয়ান, ফরাসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইম্পেরিয়াল রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে মোটরসাইকেল সরবরাহ করে।

১৯২১ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে তারা আরও দুটি নতুন ইঞ্জিনের উন্নয়ন করে। তবে এই দশ বছরে তারা যে কাজগুলো করে তার থেকেই আধুনিক মোটরসাকেলের ডিজাইনের জন্ম হয়। বর্তমানে  আজকের মোটরসাকেলের যে সব ফুয়েল ট্যাঙ্ক দেখা যায় তার প্রচলন শুরু হয় এই দশকে রয়েল এনফিল্ড কারখানায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকার পুনরায় রয়েল এনফিল্ড এর সাথে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করে। এবার এই কোম্পানি  মিলিটারি গ্রেড মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এসময় তারা ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি এবং ৭৫০ সিসি ইঞ্জিনের মোটরসাকেল তৈরি করে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল Royal Enfield WD/RE। এটি বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছিল  প্লেন থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে নিচে ফেলার জন্য।

১৯৩২ সালে The Legendary “Bullet” মোটরসাইকেলটি তৈরি করা হয়। এটি প্রথম ১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে অলিম্পিয়া মোটরসাইকেল শোতে প্রদর্শিত হয়। তিনটি ভার্সনে তৈরি হয় ২৫০ সিসি, ৩৫০ সিসি এবং ৫০০ সিসি সমস্ত ঝোঁকযুক্ত ‘স্লোপার’ ইঞ্জিন, টুইন-পোটেড সিলিন্ডারহেড, ফুট চালিত গিয়ার পরিবর্তন এবং উচ্চ কম্প্রেশন পিস্টন সহ। এই মোটরসাইকেলটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ভারতে এল রয়েল এনফিল্ড:

রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয় ভারতে। যে ভারতবর্ষকে ব্রিটেন দীর্ঘ ২০০ বছর শাসন-শোষণ করেছে, সেই ভরতেই তাদের মোটরসাইকেলের বড় বাজার গড়ে উঠে। ভরত স্বাধীনতা লাভের পর মাদ্রাজে রয়েল এনফিল্ড এর নতুন অধ্যায় শুরূ হয়। সে সময় বিস্তীর্ণ সীমানা অঞ্চল পাহারা দেওয়ার জন্য দ্রুতগতি সম্পন্ন এবং সব পরিবেশে চলার মতো মোটরসাইকেল দরকার ছিল। আর এসব পরিস্থিতিতে যেসব বাাকই উপযোগী ছিল তার মধ্যে রয়েল এনফিল্ড ছিল অন্যতম।

তাই ১৯৪৯ সাল থেকে ভরতে রয়েল এনফিল্ড বাইক বিক্রি শুরু হয়। ভারত সরকার ৮০০ ইউনিট ৩৫০ সিসি বাইক কেনে রয়েল এনফিল্ড থেকে।  ব্যবসায়ের সুবিধার্থে ১৯৫৫ সালে রেড্ডীচ কোম্পানি এবং মাদ্রাজ মোটর্স একত্রে রয়েল এনফিল্ড গঠন করে। এই কোম্পানির লাইসেন্সে রয়েল এনফিল্ড বুলেট ৩৫০ সিসি তৈরি করা হয়। প্রথম অবস্থায় শুধু বাইক এসেম্বলি করা হত এখানে। তবে ১৯৬২ এর পর থেকে সব যন্ত্রপাতি এখানেই প্রস্তুত করা হয়। এরপর থেকে রয়েল এনফিল্ড ইন্ডিয়াকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর ১৯৯০ সালে তারা আইসার মটোরসের সাথে একত্রে বাইক উৎপাদন শুরু করে। ২০১৫ সালে রয়েল এনফিল্ড তাদের উত্তর আমেরিকান হেড কোয়ার্টর তৈরি করে আমেরিকার উইস্কন্সিনে। 

জনপ্রিয়তা:

রয়েল এনফিল্ড বাইকের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। ২০১৫ সালে তারা গ্লোবাল সেলে হার্লে ডেভিডসনকে হারিয়ে শীর্ষে উঠে। হার্লে ডেভিডসন সারা বিশ্বে যত বাইক বিক্রি করেছে তার থেকে বেশি বাইক শুধু ভারতেই বিক্রি করেছে Royal Enfield। বর্তমান সময়ে তারা সারা বিশ্বে ৫০ টিরও বেশি দেশে বাইক বিক্রি করছে। তাই তাদের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কিছু কারণ রয়েছে।

ভারতীয়রা এই বাইক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই বাইক বিক্রি হয়ে আসছে বলে ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব পণ্য মনে করে।

Royal Enfield ব্যবহারকারীদের রয়েছে বিশাল কমিউনিটি। এসব কমিউনিটি যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় কাজ করে, তেমনি অঞ্চল ভিত্তিক কাজ করে। বাইক সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যায় তারা একে অন্যকে সাহায্য করে। রয়েল এনফিল্ড মোটরসাইকেলের রয়েছে অনন্য ডিজাইন। সেই ৫০ এর দশক থেকে তারা প্রায় একই ধরনের ডিজাইন ব্যবহার করে আসছে। আর এই সকল ডিজাইনই রয়েল এনফিল্ডকে রাস্তায় চলা অন্য মোটরসাইকেল থেকে আলাদা করে।

Royal Enfield এর রয়েছে উচ্চগতি এবং মাইলেজ। তারা ২৫০ সিসি থেকে ৭০০ সিসি ইঞ্জিন বানিয়েছে যার মধ্যে সিঙ্গেল স্ট্রোক এবং ভি-টুইন ইঞ্জিন রয়েছে।

এই ইঞ্জিন গুলোর ফুয়েল ইফিসিয়েন্সি ভাল। সব রাস্তায় চলাচলের জন্য এই বাইক উপযুক্ত। সমতল থেকে তুষারবৃত পাহাড়ি রাস্তা, কাঁদা যুক্ত জমি থেকে শুষ্ক মরুভূমি, সব রাস্তায় পাওয়া যাবে এই বাইককে।

Royal Enfield বিভিন্ন দেশে তাদের বাইক লোকালি প্রস্তুত করে। তাই এর মূল্য সাধ্যের মধ্যেই থাকে।

ভারতের চলচ্চিত্র এবং বিজ্ঞাপনে এই বাইক অতিমাত্রায় ব্যবহার করা হয়। এতে করে বেশির ভাগ মানুষ স্টাইলের জন্য বাইক ক্রয় করে থাকে।

Royal Enfield এমনই এক বাইক কোম্পানি যার বিশ্বজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। সব দেশে, সব পরিস্থিতিতে, সব পেশার মানুষের জন্য বাইক তৈরি করে এই কোম্পানি।

Info IT BD সকল আপডেট পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেলে

About The Author

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top